
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হলো: প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে, যা আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধির পথে জাতিকে এগিয়ে নেবে এবং গত ১৬ বছরের নৃশংসতার অবসান ঘটাবে।
তিনি বলেন, “আজ আমাদের নতুন জন্মের দিন। এই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই আমরা নতুন বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করছি।”
আজ বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক জুলাই জাতীয় সনদু২০২৫ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, সকল মতভেদ ভুলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে সনদের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই পরিবর্তন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ছাত্রুজনতার নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলেই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমাদের জাতীয় জীবনে পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের সংবিধান ও সরকার পরিচালনার পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।”
তিনি বলেন, যে তরুণরা এই পরিবর্তনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে, তারাই নতুন করে দেশকে গড়ে তুলবে। “তরুণরাই আমাদের পথ দেখাবে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেশটি তরুণদের। ১৮ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেকই ২৭ বছরের নিচে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যও এক উদাহরণ স্থাপন করেছে।
তিনি বলেন, “অনেক দেশ আমাদের কাছে জানতে আসবে—কিভাবে আমরা গোটা জাতিকে সম্পৃক্ত করে জুলাই সনদ স্বাক্ষর সম্ভব করেছি।”
অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একযোগে সনদে স্বাক্ষর করেন।
বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা সভাপতিত্বে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ, আহত ও বীরদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আজ আমরা সেই সাহসী বীরদের—শহীদ ও আহতদের—স্মরণ করছি এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাঁদের অবদানের কারণেই আমরা আজকের এই সুযোগ পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এবং সমগ্র জাতি তাঁদের প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতি নৃশংসতা থেকে সভ্যতায় ফিরে এসেছে, যেখানে আগে আইনের শাসন ছিল না, মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারত।
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সভ্যতার পথে পা বাড়িয়েছি। আমরা এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলব, যা দেখে বিশ্ববাসী ঈর্ষান্বিত হবে। তবে সেটি নির্ভর করবে জুলাই সনদ-পরবর্তী সময়ে আমাদের কর্মের ওপর।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল—যদি আমরা সমাজকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারি।’
জুলাই জাতীয় সনদকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ঐক্যের প্রসঙ্গ টেনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি আমরা সনদের মতো অন্য বিষয়েও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি, তাহলে আমাদের দেশ একটি অনন্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আমাদের সেই শক্তি রয়েছে।’
দেশের সম্পদ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশেরই অংশ এবং এটি সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও এখনও অব্যবহৃত রয়েছে।
তিনি বলেন, সনদ দেশের ভেতরে শৃঙ্খলা এনেছে। তাই ঐক্য বজায় রেখে এবং শৃঙ্খলার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করলেই জাতীয় সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
গভীর সমুদ্রবন্দর প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে, তাহলে বিশ্বব্যাপী জাহাজগুলো আমাদের পণ্য সিঙ্গাপুরে নয়, বাংলাদেশেই আনতে বাধ্য হবে।’
অঞ্চলভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যদি আমরা নেপাল, ভুটান ও ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোকে যুক্ত করে সমুদ্রপথে একটি আঞ্চলিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারি, তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে সমৃদ্ধ হব।’
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন যে নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করতে চাই, যা জাতি ও বিশ্ব উভয়ের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমরা তা করব, ইনশাআল্লাহ।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার আগামী নির্বাচনকে সেই ঐক্যের সুরে আয়োজন করতে চায়, যা আজকের জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরকে পরিচালিত করেছে।
তিনি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর পরিবেশে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা সেই ঐক্যের সুরে নির্বাচনের পথে যাব, যা সনদ স্বাক্ষরের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ঐক্য অটুট রাখুন।’
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর ‘দ্য রোডম্যাপ অব ফিউচার’ শিরোনামে সাত মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়, যেখানে শাপলা চত্বর হত্যাযজ্ঞ, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, খুন, গুম, ‘আয়না ঘর’ ও লুটপাট, অতীতের দুঃশাসনের চিত্র এবং ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান ও জুলাই জাতীয় সনদের বিষয় তুলে ধরা হয়।
পরে প্রধান উপদেষ্টা সনদে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং মঞ্চে ফটোসেশনে অংশ নেন।