
মাটি: কৃষির জননী, জীবনের জননী
মাটিই কৃষির প্রাণ, জীবনের মূলধারা। মাটি কেবল নিছক একগুচ্ছ পদার্থ নয়- এটি জীবনের নীরব অভিভাবক, মানবসভ্যতার আঁতুড়ঘর, আর প্রকৃতির অনন্ত হৃদস্পন্দন। মাটিকে যথার্থই কৃষির জননী, আবার জীবনের জননীও বলা যায়।
ফসল ফলানো, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, কিংবা পরিবেশের সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা- সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে মৃত্তিকার স্বাস্থ্য ও উর্বরতা। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর ও জনবহুল দেশে এর গুরুত্ব বহুমাত্রিক ও গভীরতর। মাটিকে শুধু কৃষি উৎপাদনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবেই দেখা যায় না; বরং এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, জাতীয় অর্থনীতি, গ্রামীণ জীবিকা, সামাজিক স্থিতি, এমনকি হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
কিন্তু দুঃখজনক ও উদ্বেগজনকভাবে, সাম্প্রতিক গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা বলছে- মৃত্তিকার স্বাস্থ্যের ধারাবাহিক অবনতি এখন জাতীয় পর্যায়ের এক গুরুতর সংকটে রূপ নিয়েছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ কৃষি, জীবিকা ও পরিবেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পবর্জ্য, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিমাত্রায় ব্যবহার এবং অনিয়ন্ত্রিত সেচ ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের মাটি দ্রুত তার উর্বরতা হারাচ্ছে। এর ফলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, অথচ ফসলের গুণমান ও পরিমাণ উভয়ই হ্রাস পাচ্ছে। মাটির জৈব পদার্থের ঘাটতি এবং অতিরিক্ত চাষাবাদ মাটির প্রাকৃতিক পুনর্জীবন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষি ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া নদীভাঙন, বন উজাড়, অনুপযুক্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উর্বর কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
বিশেষ করে, নদীতীরবর্তী ও উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা প্রতি মৌসুমে জমি হারাচ্ছেন, যা শুধু উৎপাদন নয়, তাদের জীবন-জীবিকাকেও অনিশ্চিত করে তুলছে।
অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের ব্যবহার মাটির পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট করছে। এর ফলে মাটির জৈব উপাদান ও উপকারী অণুজীবের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একই সঙ্গে মাটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে এর জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, যা খরা-প্রবণ এলাকাগুলোর জন্য এক বড় বিপদ।
শিল্পবর্জ্য, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, দূষিত পানি এবং নগরায়ণের কারণে মাটিতে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ ও আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। এগুলো খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছেÑ যেমন ক্যানসার, স্নায়বিক সমস্যা এবং শিশুদের বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা। একই সঙ্গে মাটির উপকারী জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে প্রাকৃতিক উর্বরতা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঘনঘটা এবং নদীর মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ধান ও ডালজাতীয় ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন বিকল্প জীবিকা যেমনÑ অপ্রচলিত ফসল চাষ, চিংড়ি চাষ বা শহরমুখী অভিবাসনের পথে যেতে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একাধিক সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি : ১. সমন্বিত মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা : জৈব কৃষি, সবুজ সার, ফসল আবর্তন, সুষম সার প্রয়োগ এবং সংরক্ষণমূলক চাষাবাদকে জাতীয় কৃষি কৌশলের অংশ করতে হবে। এতে মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি, পুষ্টি ভারসাম্য বজায় রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা রক্ষা সম্ভব হবে। ২. উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার : রিয়েল-টাইম মৃত্তিকা স্বাস্থ্য নিরীক্ষার জন্য ডিজিটাল সেন্সর, রিমোট সেন্সিং ও জিআইএস-ভিত্তিক মানচিত্রায়ণ ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে। এতে কৃষকরা ফসল অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, যা খরচ কমাবে ও মাটি রক্ষা করবে। ৩. উদ্ভাবনী ইনপুট : মাইক্রোবিয়াল সার, জৈব কম্পোস্ট, প্রাকৃতিক সংশোধনী এবং ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ বাড়াতে হবে। এসব প্রযুক্তি মৃত্তিকার কাঠামো উন্নত করে, জলধারণ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্ষুদ্রজীবের কার্যক্রম সক্রিয় রাখে। ৪. জলবায়ু-সহনশীল কৌশল : খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার কৌশল প্রবর্তন জরুরি। ৫. সুনির্দিষ্ট ভূমি ব্যবহার নীতি : মৃত্তিকা সংরক্ষণ, জলাভূমি পুনরুদ্ধার, পরিকল্পিত চাষের এলাকা নির্ধারণ এবং বনায়নের বিষয়গুলো নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট , মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট , বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর জন্য আধুনিক পরীক্ষাগার, দক্ষ মানবসম্পদ এবং তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি অপরিহার্য।
এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে নতুন গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়া, আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে মাঠ পর্যায়ে এই গবেষণার ফল দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আরও সক্রিয়ভাবে নিতে হবে।
যেকোনো নীতি বা প্রযুক্তি সফল করার জন্য কৃষকদের সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক। তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
জলবায়ু-সহনশীল কৌশল, মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সঠিক সার প্রয়োগের উপকারিতা বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষক স্কুল, প্রদর্শনী প্লট এবং সম্প্রসারণ সেমিনার আয়োজন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা এখন কেবল একটি প্রযুক্তিগত বিষয় নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য সার্বভৌমত্ব এবং টেকসই উন্নয়নের এক অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য উপাদান। এখনই সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি অর্থনীতি এবং গ্রামীণ জীবিকার স্থিতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু যদি সঠিক সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, কার্যকর গবেষণা, পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চা এবং সচেতন ও দক্ষ কৃষক সমাজের সমন্বয় ঘটানো যায়, তাহলে এই বর্তমান সংকটই পরিণত হতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্তে, যেখানে বাংলাদেশের কৃষি হবে আরও সহনশীল, লাভজনক, ন্যায্য এবং ভবিষ্যৎপ্রসারী।